
সরকার নির্বাচিত কিছু গণমাধ্যম ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে নিয়ে ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার সকালে ঢাকার আগারগাঁও, কচুক্ষেত ও উত্তরায় অবস্থিত তিনটি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেন তিনি।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে ওই বন্দিশালাগুলো ব্যবহার হতো যেগুলোর অবস্থান পুলিশের বিশেষ বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই)-এর কার্যালয় সংলগ্ন এলাকায় বলে জানানো হয়েছে।
গত ১৫ বছরে গুমের শিকার ব্যক্তিদেরকে ওইসব বন্দিশালায় আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
“এটা একটা বীভৎস দৃশ্য!” বন্দিশালা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন অধ্যাপক ইউনূস।
“বিনা কারণে জঙ্গি আখ্যায়িত করে মানুষকে তুলে এনে এসব টর্চার সেলে নির্যাতন করা হতো,” যোগ করেন তিনি।
‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিতি পাওয়া গোপন এসব বন্দিশালা পরিদর্শনের সময় সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টাও ছিলেন অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে।
তাদের মধ্যে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া নিজেরা যেসব ‘আয়নাঘরে’ বন্দি ছিলেন, সেগুলো চিহ্নিত করেন।
গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে বন্দি অবস্থা থেকে ফিরে আসার পর নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন যে তাদের তুলে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয়েছিল।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ আমলে গুমের শিকার জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রয়াত নেতা গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী উপদেষ্টাদের সঙ্গে ছিলেন।
জামায়াতে ইসলামীর আরেক প্রয়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে আহমেদ বিন কাশেমও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
তবে এই সফরে সঙ্গী হিসেবে ডাক পায়নি আওয়ামী লীগ আমলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’।
“সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন প্ল্যাটফর্মটির সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম।
তারপরও অন্য সূত্র থেকে বিষয়টি জানতে পেরে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বলে জানিয়েছে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠনটি।
“আমরা তাদেরকে জানাইছিলাম যে, বারো-তের বছর ধরে যারা আন্দোলন করছে ভিকটিম পরিবারের, তাদের একজন প্রতিনিধি সেখানে থাকা দরকার। কিন্তু সেটা না করে তারা পছন্দমত কিছু লোক নিয়ে গেছে,” বলেন মিজ ইসলাম।
একইভাবে পরিদর্শনের বিষয়ে জানতেন না আলোচিত আরেক ভুক্তভোগী মাইকেল চাকমা।
“আজকে যে তারা যাবে, সে ব্যাপারে আমাকে কিছুই বলা হয়নি। আমি জানতে পারছি আজকে সকালে মায়ের ডাকের কাছ থেকে। তারপর মিডিয়ায় নিউজ দেখলাম,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ‘আয়নাঘরে’ নামক গোপন বন্দিশালায় আটক থাকা মি. চাকমা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংগঠন ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে’র (ইউপিডিএফ) এই নেতা বলছিলেন যে, বুধবার তিনি সশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে পারলে গুম কমিশনকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রমাণ জোগাড়ে সহায়তা করতে পারতেন।
“ছবি দেখেই আমি কিছু জায়গা চিনতে পারছি। আমাকে যদি বলতো, আমি দেখিয়ে দিতে পারতাম কোন জায়গায় কী ছিল, কী ঘটেছিল। কিন্তু আমার সঙ্গে তো কেউ যোগাযোগ করে না,” বলছিলেন মি. চাকমা।
ইউপিডিএফের এই নেতাকে ২০১৯ সালের নয়ই এপ্রিল ঢাকার শ্যামলী এলাকা থেকে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনার পতনের পরের দিন, অর্থাৎ ছয়ই অগাস্ট চট্টগ্রামের একটি রাস্তার পাশে তাকে চোখ বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করে গেছে’
গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার গত দেড় দশকে বাংলাদেশে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বা অন্ধকার যুগ প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস।
“আইয়ামে জাহেলিয়া বলে একটা কথা আছে না, গত সরকার আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করে গেছে। এটা তার একটি নমুনা,” গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন শেষে বলেন অধ্যাপক ইউনূস।
গোপন বন্দিশালাকে এক কথায় ”বীভৎস’ বলে বর্ণনা করেন তিনি।
“যতটাই শুনি মনে হয়, অবিশ্বাস্য, এটা কি আমাদেরই জগৎ, আমাদের সমাজ? যারা নিগৃহীত হয়েছেন, তারাও আমাদের সমাজেই আছেন। তাদের মুখ থেকে শুনলাম। কী হয়েছে, কোনো ব্যাখ্যা নেই,” বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
বাংলাদেশে এ ধরনের ঠিক কতটি গোপন বন্দিশালা রয়েছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানাতে পারেনি সরকার।
তবে ঢাকার বাইরেও অনেক স্থানে গোপন বন্দিশালা রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
“এই রকম টর্চার সেল (নির্যাতনকেন্দ্র) সারা দেশে আছে। ধারণা ছিল, এখানে কয়েকটা আছে। এখন শুনছি বিভিন্ন ভার্সনে (সংস্করণে) দেশজুড়ে আছে। সংখ্যাও নিরূপণ করা যায়নি,” সাংবাদিকদের বলেন অধ্যাপক ইউনূস।
এসব গোপন বন্দিশালায় পাওয়া তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষণ করে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে জানিয়েছে সরকার।
Biplob Ahmmed, [2/14/2025 1:56 AM]
যদিও ইতোমধ্যেই অনেক আলামত নষ্ট করা হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানান গুম কমিশনের সদস্য নূর খান।
“আলামত নষ্ট করা হয়েছে অনেক জায়গায়। অনেক জায়গায় সেলের ভেতরের জিনিসগুলি পরিবর্তিত হয়েছে পাঁচ (পাঁচই অগাস্ট) তারিখের পর,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. খান।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুমের ঘটনা তদন্তে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গত ২৭শে অগাস্ট পাঁচ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করে সরকার।
গত ১৪ই ডিসেম্বর তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে কমিশন।
তৎকালীন প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও গুমের ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে জানানো হয়।
তাদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
এদের মধ্যে অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান গ্রেফতার রয়েছেন। অন্যদের পক্ষ থেকেও এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
গুমের ঘটনায় বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর পাশাপাশি র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেন কমিশনের সদস্যরা।
আগামী মার্চে গুম বিষয়ে বিস্তারিত আরও একটি তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।