ABDUL Mabud:
স্টাফ রিপোর্টার।
গতকাল বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রফেসর ইউনুস প্রায় ২৫ মিনিটের একটি বক্তব্য দেন। পুরো বক্তব্যটি যদি আপনি মনোযোগ দিয়ে শুনেন তাহলে আপনি অবাক হবেন!
যেমন দারুন ছিল তার স্ক্রিপ্ট, তেমনি দারুন ছিল তার বিষয়ের সিকোয়েন্স। প্রফেসর ইউনুস কখনো লিখিত বক্তব্য দেন না তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু কথাগুলো যেভাবে তিনি সাজিয়েছে, তাতে আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না।
প্রথমে কালকের বক্তব্যের একটা অংশ নিয়ে সমালোচনা হয়েছে তার জবাব দেই।
গতকালকে প্রফেসর ইউনুসের বক্তব্য মোটামুটি সবাই প্রশংসা করলেও কিছু ব্যক্তি দেখলাম সমালোচনা করেছেন যে, উনি কিছুটা আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছিলেন যখন তিনি ৭১ এবং তার পরবর্তী সময় ৭৪-এর দুর্ভিক্ষের কথা বলছিলেন। কেউ কেউ বলছেন এটা রাজনীতিবিদদের মতো কান্না! আবার কেউ কেউ বলছেন এখানে কান্নার কি হলো? তবে বেশিরভাগই তার এই ইমোশনকে পজেটিভলি দেখেছেন। এটাকে কেউ ‘স্বজন হারানোর বেদনা’ হিসেবে দেখছেন না।
আমার মতে প্রফেসর ইউনূসের এই আবেগ যুক্তিযুক্ত। তিনি দেশকে ভালবাসেন। তিনি সারা বিশ্বের দারিদ্রতা দেখেছেন। উনার ধ্যান-জ্ঞান হল দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়া। এছাড়া উনার বয়সও আবেগ তাড়িত হবার জন্যও যথেষ্ট। তাই উনার এই আবেগকে আমি খুব ভালোভাবেই গ্রহণ করি।
এবারে উনার পুরো বক্তব্যটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।
প্রফেসর ইউনুস, গতকাল যেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিলেন, সেখানে তার অডিয়েন্স হল সারা বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ। যারা আবেগ থেকে বেশি মূল্য দেন লাভ আর ক্ষতির হিসাবকে।
এমন একটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রফেসর ইউনুসকে এমন একটি বক্তৃতা দিতে হবে যা শুনে এই হিসেবী মানুষগুলো চিন্তা করতে বাধ্য হবেন যে, হ্যাঁ! বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য লাভজনক এবং উপযুক্ত স্থান।
তেমনি প্রেক্ষাপটে মঞ্চে দাঁড়ালেন তিনি। যিনি একজন নোবেল বিজয়ী। যাকে সারা বিশ্ব চেনে, সম্মান করে। উপস্থিত অডিয়েন্স নড়েচড়ে বসলো। কি বলবেন এই বিশ্বজয়ী ব্যক্তিত্ব? যা শুনে তাদের মনে হতে পারে যে, বাংলাদেশ ইনভেস্ট করার জন্য উপযুক্ত স্থান।
মঞ্চে এসে প্রফেসর ইউনুস গুড মর্নিং, গুড ইভিনিং বললেন না। খুব সাবলীলভাবে সালাম দিয়ে শুরু করলেন। তারপরের কথাটাই বললেন, আজকের অনুষ্ঠানটি খুবই আবেগঘর অনুষ্ঠান। বলে তিনি সকলকে দাঁড়িয়ে সম্মাননা জানাতে বললেন, সদ্য বাংলাদেশী নাগরিকত্ব পাওয়া কোরিয়ান নাগরিক ইয়াং ওয়ান কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে। যিনি ৪৫ বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করছেন এবং যার কোম্পানিতে প্রায় ৭৫ হাজারের অধিক কর্মী চাকরি করছে।
প্রফেসর ইউনুস জানেন মানুষকে কিভাবে সম্মান দিতে হয়। নাগরিকত্ব দিয়ে কিহাক সাংকে তো সম্মানিত করা হলোই, এবারে সকলে দাঁড়িয়ে আবার তাকে সম্মানিত করলেন। ব্যক্তিগতভাবে এটা দেখে আমি নিজে আসলে খুব গর্বিত এবং আপ্লুত হয়েছি।
যাইহোক, এরপর তিনি ৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করেন। যেখানে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যায়। এ সময় তিনি আবেগ তাড়িত হন, বাকরুদ্ধ হন এবং কিছু সময় চুপ থাকেন।
সে সময় বাঙালি জাতি ছিল কৃষি নির্ভর একটি জাতি। এরপর ৭৪ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত একটা দীর্ঘ সময়কাল পার করেছে বাংলাদেশ। এখন ১৮০ মিলিয়নের এক বিশাল মার্কেট। যেখানে রয়েছে তারুণ্য নির্ভর বিশাল মেধাবী জনগোষ্ঠী।
এ প্রসঙ্গে তিনি গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠার গল্পটা বলেন। তখন তার আইডিয়া ছিল, মোবাইল ফোন তিনি গ্রামের দরিদ্র মহিলাদের কাছে দিবেন। তার এই আইডিয়া শুনে সকলেই খুব অবাক হয়েছিল। অথচ এখন সেই ফোন-এর বিশাল মার্কেট বাংলাদেশ।
বাংলাদেশকে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন, ক্রেজি আইডিয়া বাস্তবায়নের তীর্থভূমি হিসেবে। তারপর তিনি বলেন, ব্যবসায় প্রফিট করা আনন্দের কিন্তু তার সাথে যদি সামান্য কিছু যোগ করা যায় তাহলে সেটা আরো বেশি আনন্দময় হয়। তা হল, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু করতে পারা। আর বাংলাদেশে কাজ করলে সেই আনন্দটাই পাওয়া যায়। এ সময় তিনি চমৎকার একটি ডায়লগ দেন।
“Making money is happiness but making other people happiness is a super happiness. If you have a business in Bangladesh, you have both. Happiness and super happiness.”
একজন ব্যবসায়ী শুধু অর্থ উপার্জন করবে এরই মধ্যে তার আনন্দ নিহিত নয়। বরং অর্থ উপার্জনের সাথে সাথে যদি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নের অবদান রাখা যায় তাহলেই আসল সুখের সার্থকতা। দারুনভাবে তিনি এটা বোঝালেন।
এরপর তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেন। বাংলাদেশে ব্যবসা মানে শুধু বাংলাদেশকেই আমরা দেখি না, আমরা এই পুরো রিজিওনকেই একসাথে দেখি। যেখানে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। সেখানে আমরা একসাথে কাজ করব, একে অপরকে সহযোগিতা করব। নাম উল্লেখ না করলেও তিনি সেভেন সিস্টার্স, নেপাল এবং ভুটানকে বুঝিয়েছেন।
বিনিয়োগকারীদেরকে উৎসাহিত করতে তিনি বলেন যে, তাদের মাধ্যমেই বিশ্বের পরিবর্তন সম্ভব। তার থিওরী, তিন শূন্যের পৃথিবী গড়তে যে ব্যবসার বিকল্প নেই তা বলেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, তার মাইক্রো ক্রেডিটের কথা। যেই ব্যবসা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু হয়েছিল, তা এখন আমেরিকার মতো দেশে বিলিয়ান ডলারের ব্যাবসা।
তাই আমরা যদি সংকীর্ণ চিন্তা করি তাহলে বিশ্বকে বদলাতে পারবো না। ব্যবসা হল একটি শক্তিশালী মাধ্যম, যা বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে। আর এই পরিবর্তনের শুরুটা হোক বাংলাদেশ থেকে। কি দারুনভাবে তিনি বিনিয়োগকারীদেরকে উৎসাহিত করলেন।
আপনি যদি প্রফেসর ইউনূসের এর বক্তব্যের সিকোয়েন্সগুলো লক্ষ করেন, তাহলে আপনি অবাক হবেন যে মোটিভেশন স্পিচ কাকে বলে! সত্যিই, উনার বক্তব্য তো আসলে মানুষ এমনি এমনি টিকেট কেটে শোনেনা! আর আমরা সেটি পাচ্ছি ফ্রি-তে!! বাঙালি কি পারবে এই ফ্রি-তে পাওয়া মূল্যবান বক্তব্যের মর্যাদা রক্ষা করতে??