শ্রমিক অধিকার বনাম অনিয়ম: রংপুর জেলা ট্রাক, ট্যাঙ্ক লরি ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন বিতর্ক।

শেরার করুন

স্টাফ রিপোর্টার।

শ্রমিক সংগঠনগুলোর মূল লক্ষ্য হলো শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করা, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা এবং আইন অনুযায়ী সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করা। কিন্তু বাস্তবে, অনেক ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতেই বেশি আগ্রহী। রংপুর জেলা ট্রাক, ট্যাঙ্ক লরি, কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাক্টর শ্রমিক ইউনিয়নের সাম্প্রতিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওঠা অভিযোগগুলো সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন।

ভুয়া ভোটার ও অবৈধ শাখা কমিটি গঠন

ইউনিয়নের গঠনতন্ত্র অনুসারে শুধুমাত্র ট্রাক, ট্যাঙ্ক লরি ও কাভার্ড ভ্যানের মালিক কর্তৃক নিয়োজিত শ্রমিকরা ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ করতে পারেন। কিন্তু বর্তমান ভোটার তালিকায় হাজার হাজার বহিরাগত ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই কিংবা তারা কোনো যানবাহনের শ্রমিক নন। এভাবে প্রায় ১০০টি অবৈধ শাখা কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা প্রকৃত শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকে দুর্বল করেছে।

কোরাম হীন সাধারণ সভা ও নির্বাচনী প্রহসন

ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাধারণ সভা বৈধ হতে হলে মোট সদস্যদের ৬৬% উপস্থিত থাকতে হবে। অথচ সাম্প্রতিক সাধারণ সভায় মাত্র ৩৫০-৪০০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন, যা মোট সদস্যদের ১০%-এরও কম। তবুও, এই সভায় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয় এবং কার্যনির্বাহী কমিটি বহাল রাখা হয়।

নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান হিসেবে একজন কাউন্সিলরকে নির্বাচিত করা হয়েছে, যা গঠনতন্ত্রের বিরোধী। এছাড়া কমিটির পাঁচ সদস্যের মধ্যে তিনজন বহিরাগত, যা শ্রমিকদের জন্য উদ্বেগজনক।

শ্রম অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তা

শ্রম অধিদপ্তর ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রম তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকলেও অভিযোগের ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সাধারণ সভার আগেই সংক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হাজার হাজার ভুয়া ভোটার ও অবৈধ শাখা কমিটির বিরুদ্ধে আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরে অভিযোগ দাখিল করলেও কোনো তদন্ত করা হয়নি। বরং শ্রম অধিদপ্তরের প্রতিনিধি সাধারণ সভায় উপস্থিত থেকে অনিয়মের বিষয়টি উপেক্ষা করেন এবং কার্যনির্বাহী কমিটির ঘোষিত নির্বাচন পরিচালনা কমিটিকেই অনুমোদন দেন।

ভোটের দিনও শ্রম অধিদপ্তরের কোনো পর্যবেক্ষক উপস্থিত ছিলেন না। কেবলমাত্র উপপরিচালক নিজে দুইজন পিয়নকে নিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন, যা পুরো প্রক্রিয়াটিকে প্রহসনে পরিণত করেছে। ফলস্বরূপ, প্রকৃত শ্রমিকদের অংশগ্রহণহীন এই নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

শ্রমিকদের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ

নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির কারণে ৬/৭ জন প্রার্থী ভোট বর্জন করেন। এছাড়া শ্রমিকদের একটি অংশ শুরু থেকেই অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছেন। এবং ধারাবাহিকভাবে শ্রম অধিদপ্তরে দরখাস্ত জমা দিয়েছেন। এখন তারা প্রতিকারের নিমিত্বে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন।
শ্রমিকদের দাবিগুলো হলো:
* এই নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করে নথিভুক্ত না করা।
* কোরাম হীন সাধারণ সভাকে বাতিল ঘোষণা করে নতুন সাধারণ সভা আয়োজন করা।
* প্রকৃত শ্রমিকদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে শ্রম অধিদপ্তরের কঠোর তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করা।
* ব্যক্তিগত স্বার্থে শ্রমিকদের অধিকার হরণকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

উপসংহার

রংপুর জেলা ট্রাক, ট্যাঙ্ক লরি ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাম্প্রতিক নির্বাচনের অনিয়ম এবং শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার হরণের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। শ্রমিকদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে অবৈধ শাখা কমিটিগুলো বাতিল করা, ভুয়া ভোটার তালিকা সংশোধন করা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা জরুরি। শ্রম অধিদপ্তর যদি এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার চরমভাবে ক্ষুণ্ন হবে।

প্রশাসনের উচিত শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি বিবেচনায় নিয়ে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ইউনিয়নের কার্যক্রম তদারক ও নিয়ন্ত্রণ করা।