অতীত মুছে ফেলা প্রসঙ্গে আবু সাঈদ নামক একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীও মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত অর্জন ও পরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। “ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শাসন, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের জন্ম, শেখ হাসিনা সরকারের সকল অতীত কর্মকাণ্ড” মুছে গেছে কি না, এই প্রশ্নও রাখেন তিনি। যদিও তার ওই পোস্টে আদনান এইচ খান নামক একজন লিখেছেন, “এটি স্রেফ একটি উপমা।” এমন আরও অনেকেই ফেসবুক ও টুইটারে লিখেছেন যে মুহাম্মদ ইউনূস ওই সাক্ষাৎকারে ১৯৭১ সাল তথা বাংলাদেশ গঠনের ইতিহাসকে অস্বীকার করে কথা বলেছেন।
রিসেট বাটনে চাপ দেওয়া প্রসঙ্গে কথা বলেছেন লেখক তসলিমা নাসরিনও। তবে তার প্রশ্নটা একটু ভিন্ন। তিনি প্রশ্ন করেছেন, মুহাম্মদ ইউনূস যে তরুণদের কথা বলছেন, তাদের মাঝে কারা রিসেট বাটন টিপেছে? মুহাম্মদ ইউনূসকে বিভিন্ন ধর্ম ও মতবিদ্বেষী তরুণরা ঘিরে রেখেছে উল্লেখ করে তিনি আরও জানতে চেয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা ওই তরুণদেরকেই নতুন বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব দিতে চান কি না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘রিসেট বাটন’ লিখে সার্চ দিলে এরকম অনেক পোস্ট সামনে আসবে। যারা পোস্টগুলো করছেন, তারা সবাই যে পরিচিত বা জনপ্রিয় মুখ, তেমন না।
অনেক সাধারণ মানুষ বা যারা গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তারাও ‘রিসেট বাটন’ প্রসঙ্গে হতাশ। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন এবং সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জহিরুল ইসলাম (জেড আই) খান পান্নাও কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, মুহাম্মদ ইউনূস জ্ঞানী হলেও মুক্তিযুদ্ধে তার কোনও অংশগ্রহণ আমরা জানি না। “রিসেট বাটন কিন্তু আমরাও চাপতে পারি। আমরা ১৯৭১ সালে রিসেট বাটনে চাপ দিয়ে পাকিস্তানকে ওয়াশ-আউট করে বাংলাদেশ তৈরি করছি, সেভাবে আবারও রিসেট বাটন চাপ দিতে পারি।” জেড আই খান পান্নার এই বক্তব্যও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে শেয়ার করছেন।
অনেকে আবার এও বলছেন যে তার ওই বক্তব্য আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে। এ বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার হাঁটুতে গুলি লেগেছে। তার বন্ধুরা যুদ্ধে মারা গেছে। “সেইসময় আমাদের সামনে ছিল- আমি নিজে বাঁচবো, যে মারছে তাকে মারবো ও দেশকে স্বাধীন করবো। আমাদের কারও কোটার চিন্তা ছিল না। এটা আমি সর্বোচ্চ আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছি।” “তো, আমার ইতিহাস উনি (মুহাম্মদ ইউনূস) মুছে দেওয়ার কে?" প্রশ্ন করেন তিনি। ১৯৭২ সালের পর থেকে তিনি আওয়ামী লীগ করেন না এবং এখনও কোনও দল করছেন না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “এই কথাটা আমার কলিজার ওপর গিয়ে বিঁধছে।” “এই কথাটা হার্ট করে কিনা? তাহলে তো দাঁড়ায় যে ওনার কোনও অতীত নাই।” বিষয়টিকে আরও যেভাবে দেখা যায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইতিহাস লিখে পাঠকের কাছে বেশ পরিচিতি পেয়েছেন গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ।
মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য নিয়ে চলমান বিতর্ককে ঘিরে তার সঙ্গে কথা বলে বিবিসি বাংলা। এই লেখক ও গবেষক মনে করেন, ‘রিসেট বাটন’ নিয়ে যা হচ্ছে, তা ভুল বোঝাবুঝি। “আমি পলাশীর যুদ্ধের কথা ভুলে গেছি, পানিপথের যুদ্ধের কথা ভুলে গেছি। সিপাহী বিদ্রোহের কথা ভুলে গেছি। সাতচল্লিশও ভুলে গেছি। এখন যে জেনারেশন এই পরিবর্তন এনেছে, তাদের বয়স ২৫-৩০ বছরের নিচে। তারা একাত্তর দেখে নাই। ঠিক যেভাবে আমি পলাশী দেখি নাই।” “কথা হলো, মানুষের নানান বিষয় নিয়ে আবেগ থাকতে পারে। কিন্তু এগুলো নিয়ে যারা সমালোচনা করছে, এখানে একটা রাজনীতি আছে। তারা সবাই পরাজিত শক্তির পক্ষে,” বলছিলেন মি. আহমদ। তার মতে, ‘রিসেট বাটন’ প্রসঙ্গে এই মুহূর্তে যারা সমালোচনা করছেন, “তারা মনে করে যে একাত্তর-ই শুরু, একাত্তর-ই শেষ। অথবা, পঁচাত্তরের পর সব শেষ হয়ে গেছে।
'বঙ্গবন্ধু না থাকলে বাংলাদেশ হতো না' দাবির পাশাপাশি সমালোচনাকারীরা এখন বলছেন যে 'বাংলাদেশ একমাত্র নিরাপদ থাকে শেখ হাসিনার হাতে'- শেখ হাসিনা বিদায় হয়ে গেছে, এটা তাদের সহ্য হচ্ছে না।” মি. আহমদ আরও বলেন, “রিসেট মানে হলো, আমাদের সবকিছু আমূল সংস্কার করতে হবে। প্রচলিত ধারার রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার ব্যবস্থা, অর্থনীতি আমরা চাই না। এখান থেকে বের হতে হলে অতীত থেকে একটা ছেদ ঘটাতে হবে। উনি (মুহাম্মদ ইউনূস) যদি এটাই বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে আমি মনে করি, উনি ঠিকই বলেছেন।” উপস্থাপকের কথায় মুহাম্মদ ইউনূস কিছুটা বিরক্ত হয়ে থাকতে পারেন বলে মনে করেন তিনি।
“উপস্থাপকের প্রশ্নের উত্তর মুহাম্মদ ইউনূস এখানে এক কথায় দিয়েছেন যে এগুলো নিয়ে বসে থাকলে হবে না। ৩২ নম্বরের বাড়ি পোড়ানো হয়েছে, ভাস্কর্য ভাঙ্গা হয়েছে…৮০০-৯০০ ছেলেপেলে গুলি করে মেরে ফেলেছে, এই বিষয়গুলো তার থেকে ছোট নাকি বড়? উনি ওই প্রশ্নটাই করেছেন।”