
জাকির হোসেন
স্টাফ রিপোর্টার
বগুড়ার, দুপচাঁচিয়া উপজেলার, গুনাহার ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কিছু বেদনা দায়ক কথা।
১১, ফেব্রুয়ারি, ২০২০
র্যাব আমাকে মতিঝিলের গার্ডিয়ান অফিস থেকে তুলে নিয়েছিল। অফিসের সিসি ফুটেজ ছিল, শতাব্দী সেন্টারের সিসি ফুটেজ ছিল। মতিঝিল থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ হয়ে কেরানীগঞ্জ টু মোহাম্মাদপুর র্যাব—২।
গার্ডিয়ান অফিসে সকলের সামনে থেকে তুলে নিয়ে অস্বীকার করল। সারা-দিন সারা-রাত অস্বীকার করল।
র্যাব—২ এর গারদে আমি। রাত ৯.০০টায় ভালো মানের খাবার দিলো। খাওয়া শেষ হলেই চোখ বেঁধে ফেলল গামছা দিয়ে৷
গারদ থেকে নেওয়া হচ্ছে র্যাব—২’র সিও পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকীর রুমে। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পরে ভেতরে নিলো।
কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ফারুকী ঠান্ডা মাথায় বলল—’কেন তুই অনলাইনে বিবিসি, সিএনএন, প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ পত্রিকার ভুয়া ইউআরএল তৈরি করে সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক নিউজ ছড়াস? তুই শিবির করোস, ঠিক না? তোর সব রেকর্ড আমার হাতে। সব স্বীকার করে নে। তোর আজ রক্ষা নাই। কোনো কিছু গোপন করলেই শেষ তুই।’
আমাকে তুলে নিয়েছিল এই অভিযোগে যে, কোরিয়া প্রবাসী ড. এনামুল হক মনি ভাইয়ের সাথে যোগসাজশ করে আমরা অনলাইনে স্বনামধন্য পত্রিকার ভুয়া লিংক তৈরি করে সরকার বিরোধী কাজে মত্ত। বিনিময়ে মাসে ৩/৪ হাজার টাকা কামাই করি। হাসিনার বিরুদ্ধে অবমাননাকর ক্যাম্পেইন করি।
মহিউদ্দিন ফারুকী প্রশ্ন করেই উত্তেজিত হয়ে গেল। আমার উদ্দেশ্যে বলল—এই শুয়োর এখনও দাঁড়িয়ে আছে কীভাবে, সাইজ করিসনি তোরা?
দাঁড়িয়ে গেল সম্ভবত। অশ্লীল গালি।
কী মনে করে সে আমার পর্যন্ত এলো না। আমার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা দুই অফিসার নিশ্চুপ। ফারুকী বলল—পেটা ওরে।
আমি খুবই শান্তভাবে বললাম—২ মিনিট কথা বলতে পারি?
কেন জানি বলতে দিলো৷
বললাম—দেখুন, আমাকে মারুন। তবে তার আগে কিছু বলতে দিন৷ বলার পর যদি মনে হয়, আমাকে মারা দরকার খুব, মারুন।
বললাম—’আমার নাম নূর মোহাম্মাদ আবু তাহের। বাড়ি বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলায়। পড়াশোনা করেছি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রশিবিরের সর্বোচ্চ মানের জনশক্তি সদস্য ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের নেতৃত্ব দিয়েছি। এখন প্রকাশনা ব্যবসা করি। জামায়াতের রুকন। ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৬ ভোটে পরাজিত হয়েছি। সামনে ২০২২ সালে ইউপি নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি করি, জামায়াতের সক্রিয় কর্মী। সোস্যাল মিডিয়াতে আমার সকল কাজ দৃশ্যমান, কোনো গোপন কাজের সাথে দশমিক এক শতাংশও সম্পৃক্ততা নাই আমার। যে অভিযোগ তোলা হয়েছে আমার নামে, তা আপনি এখানে প্রমাণ করতে পারলে যা শাস্তি দেবেন মেনে নেবো। হ্যাঁ, আমি সরকার বিরোধী তরুণ এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন প্রত্যাশা করি।’
হুবহু এই শব্দগুলো হয়তো না, তবে মোটাদাগে এমনই বলেছিলাম।
আমার কথা শুনে ফারুকী হেসে দিলো। বলল—এত সহজে সব স্বীকার করলে, সব পরিচয় দিয়ে দিলে?
খেয়াল করলাম, তুই থেকে তুমি সম্বোধন করলেন।
বললাম, আমার বক্তব্য পরিস্কার করলাম, এখন যদি মারতেই হয়, মারুন।
ফারুকী মারল না। আমার চোখে বাঁধা গামছা খুলে দিলো। সামনে বসতে বলল। চা নিয়ে আসতে বলল। অনেক আলাপ হলো। ঘন্টা দুয়েক৷ আমার সহজ স্বীকারোক্তিকে এপ্রোশিয়েট করল। তখন জামায়াতের পরিচয় স্বীকার করা মানেই বিপদ কবুল পড়া। সত্য বলার জন্য ধন্যবাদ দিলো। আমার বক্তব্য বিশ্বাস করল।
ফারুকীর চেয়ারের পেছনে একটা দরজা। খোলা ছিল। পেছনে রুমের মতো। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, দেয়ালে হ্যান্ডকাফ ঝুলানো, ছাদে হ্যান্ডকাফ ঝুলানো। ইলেক্ট্রিক তার। বুঝলাম, ওই রুমে কী হয়৷
সরকার, জামায়াত, ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে অনেক কথা হলো। ফারুকী আমাকে গারদে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলো। আমি জায়নামাজ আর একটা কুরআন চাইলাম, তাও ব্যবস্থা করে দিতে বলল।
পরেরদিন গারদে বসে আছি৷ পাশের রুমগুলো থেকে আহাজারির আওয়াজ।
আমার আটকের কথা কোনোভাবেই স্বীকার করছিল না। সংগঠন বিভিন্ন চ্যানেলে মুভ করেছে, কিন্তু হদিস পাচ্ছিল না।
সকালে খাবার দিতে আসলো একজন কনস্টেবল। তিনি আমাকে দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। তার বাড়ি গুনাহার ইউনিয়নে, আমার জন্মভূমিতে। আমি চিনতাম না, তিনিই ফিসফিস করে পরিচয় দিলেন৷ আমি যে গুম হতে যাচ্ছি, উনি জানতেন।
তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! খানিক বাদে সামলে নিলেন। ইশারায় আমাকে কিছু ম্যাসেজ দিচ্ছিলেন৷ আমি কলম চাইলাম আর সিগারেটের প্যাকেট। ইচ্ছে ছিল, সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে কিছু লিখে দেবো। তিনি বুঝালেন, দেওয়া যাবে না৷ সিসি ক্যামেরা আছে।
আমাকে খাবার দিয়ে দিয়ে বাহিরে গেলেন৷ কিছুক্ষণ পর এসে জানালেন—ওকে, ডান৷
বুঝলাম, তিনি কাউকে না কাউকে জানিয়েছেন, আমি র্যাব-২ এ৷ এই লোকটার প্রতি আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ, অনেক ঝুঁকি নিয়ে সাহায্য করেছিলেন৷
> Md. Jakir Hossain:
আল্লাহ তায়ালা এমন সিচুয়েশনে কীভাবে এলাকার লোক ম্যানেজ করে দিলেন, চিন্তা করলে আজও সিজদায় মাথাবনত হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সাহায্য এমনই৷
কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম, অনেকগুলো গাড়ি। গারদ থেকে গাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে৷ প্রেসের গাড়ি; সাংবাদিক, ক্যামেরা৷ বুঝলাম—সংগঠন আমার অবস্থান ট্রেস করতে পেরেছে, সাংবাদিকদের সংগঠনই পাঠিয়েছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে জানানো হলো, আপনাকে কোর্টে প্রোডিউস করা হবে৷ আলহামদুলিল্লাহ পড়লাম।৷
ঘন্টাখানেক পরে আমাকে গারদ থেকে বের করা হলো। বলা হলো, প্রেসের কেউ যদি কোনো প্রশ্ন করেই বসে তাহলে বলবেন মোহাম্মাদপুর থেকে আপনাকে রাতে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রেসের সামনে যেভাবে নেওয়া হয় আর কি! দুপাশে কালো সানগ্লাস আর কালো পোশাকের র্যাব, মাঝখানে আমি। ব্রিফিং করল আমার অপরাধ।
আমি কোর্টে গেলাম।
রিমাণ্ড বাতিল করে কোর্ট আমাকে কারাগারে পাঠালো।
তখন আমার একমাত্র সন্তানের বয়স আড়াই মাস৷ বাচ্চার মা তার ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে বগুড়া থেকে ঢাকায় এসেছে।
কারাগেটে আমি বললাম তোমরা র্যাব-২-এ গিয়ে আমার ম্যানিব্যাগ আর মোবাইল নিয়ে আসো৷ ম্যানিব্যাগে ব্যাংক কার্ডসহ প্রয়োজনীয় কিছু ডকুমেন্টস ছিল।
ওরা র্যাব-২-এ গিয়েছিল। সেখানে আমার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব অফিসার এমন এক আচরণ করেছিল, মৃত্যুর আগেও ভুলতে পারব না।
আমার স্ত্রীর সাথে শাশুড়ীও গিয়েছিল। এক তরুণীর আড়াই মাসের বাচ্চা তার কোলে, সাথে তার মা। তরুণীর স্বামী কারাগারে। তাকে র্যাব অফিসার বলে দিলো—’কেমন ছেলেকে বিয়ে করেছেন হ্যাঁ? সন্ত্রাসী। নূর মোহাম্মাদ আর কোনোদিন বের হতে পারবে না। আইসিটি মামলায় চালান দিয়েছি আমরা, খুব শীঘ্রই রিমাণ্ডে নিয়ে আসব। স্বামীর নাম ভুলে যান৷, ডিভোর্স দিয়ে নতুন কাউকে বিয়ে করুন’।
আপনি একবার কল্পনা করুন তো দৃশ্যপটটা! আড়াই মাসের বাচ্চা কোলে, সাথে নিজের মা। ওকে বলছে, সে যেন তার সন্ত্রাসী স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। দুনিয়ার কোন আইন তাকে এই অধিকার দিয়েছে? পারিবারিক শিক্ষাটাও কোন পর্যায়ের?
জীবনে ৬ বার গ্রেফতার হয়েছি। বিয়ের আগে ৩ বার, বিয়ের পরে ৩ বার৷ কারাগার-কেন্দ্রীক এতটা কষ্ট আর কখনো পাইনি, যতটা কষ্ট পেয়ছি এই ঘটনায়। এখনও মাঝেমধ্যে হিশামের মা ওই অফিসারের কথা জিজ্ঞেস করে। সে যথেষ্ট ধৈর্যশীলা এবং আমার সাংগঠনিক জীবনের সাহায্যকারী। কিন্তু এই ঘটনা তার মানস থেকে আজও ডিলিট হয়নি৷
অফিসার কোথায় আছে জানি না। জালিম কি এসব মনে রাখে? কত শত জুলুম সে স্বরণে রাখবে?